
“অগ্নি দর্পন”
নাট্যজগৎ সবসময়ই সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করে, যেখানে শিল্পী, দর্শক এবং সমাজ বাস্তবতার দ্বন্দ্ব ও সৌন্দর্যকে একই মঞ্চে একত্রিত করে। পূর্ব-পশ্চিম নাট্যসমন-এর চতুর্থ প্রযোজনা হিসেবে ২৬ মে ২০২৫, সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয় চন্দন সেনের লেখা ও জনি মাহমুদের নির্দেশনায় “অগ্নি দর্পন” নাটকটি। নাট্যটির প্রযোজনা, মঞ্চ বিন্যাস, আলো, শব্দ, পোশাক এবং রূপসজ্জায় যেভাবে দলীয় সমন্বয় ঘটেছে তা এক অনবদ্য শিল্প অভিজ্ঞতায় রূপ নিয়েছে।
নাটকের প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তু
চন্দন সেনের নাটক “অগ্নি দর্পন” মূলত এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। এখানে অগ্নি প্রতীক হয়ে ওঠে ধ্বংসের পাশাপাশি শুদ্ধির প্রতীক, আর দর্পন হয়ে দাঁড়ায় আত্মসমালোচনার এক নির্মম আয়না। নাটকে মানুষের লোভ, দ্বিচারিতা, নিপীড়ন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্ধ দম্ভের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে একে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নাটক হিসেবে দেখলে ভুল হবে, কারণ এটি মানুষের অন্তর্লোকের জটিলতা, সমাজের ভাঙন ও সময়ের সঙ্গে মানুষের টানাপোড়েনকে একসঙ্গে ধারণ করে।
নাটকটির কাহিনি ধীরে ধীরে খুলে যায় এবং দর্শককে এক গভীর প্রশ্নে নিয়ে যায়—আমরা কি আমাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারি? একবিংশ শতাব্দীতে এসে দাঁড়িয়েও মানুষ কেন এত নির্মম, নিঃস্বার্থ নয়? এমন অসংখ্য প্রশ্ন দর্শকের মনের ভেতরে উঁকি দিতে থাকে।
নির্দেশনা ও মঞ্চায়ন
জনি মাহমুদের নির্দেশনায় নাটকটি নাট্যরীতির আধুনিকতা এবং শুদ্ধতার এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। তিনি চন্দন সেনের রচনার গভীরতা ও সংকেতগুলোকে খুব দক্ষভাবে মঞ্চে রূপান্তর করেছেন। প্রত্যেকটি দৃশ্য পরিকল্পিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা দর্শককে কখনো আবেগপ্রবণ করেছে, কখনো বা চরম বাস্তবতায় আঘাত করেছে।
নির্দেশকের মঞ্চ পরিকল্পনায় কেবল চরিত্রগুলোর চলাচল নয়, বরং শব্দ, আলো ও সৃজনশীল নকশাও নাটকের ভাবপ্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দৃশ্যান্তরের সময় ব্যবহৃত আবহসংগীত ও শব্দ প্রক্ষেপণ নাটককে একটি থ্রিলার ধাঁচে নিয়ে গেছে। গল্পটি যত গভীর হয়েছে, ততই দর্শক যেন এক মানসিক অভিযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছে।
মঞ্চ, আলো ও দৃশ্য পরিকল্পনা
মঞ্চ ও আলোর দায়িত্বে ছিলেন ফারুক হোসেন, যিনি নাটকের আবহ সৃষ্টি এবং চরিত্রগুলোর মানসিক অবস্থানকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে নাটকের ক্লাইম্যাক্স মুহূর্তগুলোতে আলো ও ছায়ার যে রকম ব্যবহার ছিল, তা নাট্যশিল্পে এক উচ্চমানের পেশাদারিত্বের প্রমাণ দেয়। কখনো লাল আলো আগুনের প্রতীক হয়ে এসেছে, আবার কখনো নীল বা ধূসর আলো চরিত্রগুলোর বিষণ্ণতা বা দ্বিধা প্রতিফলিত করেছে।
সৃজনশীল নকশায় রাজীব জামান নাটকের মূলে থাকা প্রতীকগুলোকে দৃশ্যরূপে রূপান্তর করেছেন। নাটকের নাম ‘অগ্নি দর্পন’—এই দুটি উপাদানের প্রতীকী ব্যাখ্যা তিনি রূপায়ন করেছেন মঞ্চের বিভিন্ন উপাদানে: ভাঙা দর্পণের প্রতিরূপ, জ্বলন্ত প্রদীপ, অথবা এক প্রাচীন চিত্রকর্ম যা সময়ে ক্ষয়প্রাপ্ত।
পোশাক ও রূপসজ্জা
মঞ্জিল হোসেনের পোশাক পরিকল্পনায় দেখা গেছে চরিত্রভিত্তিক বস্ত্রের পরিশীলিত নির্বাচন। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের পোশাক যেমন ছিল বাস্তবসম্মত, তেমনি নাটকের প্রতীকী দিকগুলোও উঠে এসেছে পোশাক বিন্যাসে। উদাহরণস্বরূপ, শাসক শ্রেণির পোশাক ছিল জাঁকজমকপূর্ণ অথচ অনড়, আর সাধারণ মানুষের পোশাক ছিল মলিন ও গরিবি হালতে, যা নাটকের শ্রেণিবিভাজনের বাস্তবতাকে প্রকাশ করে।
রূপসজ্জায় খলিলুর রহমান চরিত্রগুলোর মানসিক ও সামাজিক অবস্থানকে দৃশ্যমান করেছেন। বিশেষ করে একজন চরিত্রের ক্ষয়ে যাওয়া মুখ, অথবা একজন বিপ্লবীর চোখের নিচে কালি, এসব ছোট ছোট খুঁটিনাটি দিক নাটকটিকে আরও বাস্তবমুখী করে তোলে।
আবহসঙ্গীত
আরিফুল ইসলাম অনিকের আবহ সঙ্গীত নাটকের অনুভূতির গভীরতা বাড়িয়েছে বহুগুণ। কখনো মৃদু বাজনা, কখনো উচ্চ শব্দের কম্পন—এই সাউন্ডস্কেপ নাটকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে নীরবতা এবং হঠাৎ শব্দের প্রক্ষেপণ দর্শকের আবেগের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে অনায়াসে।
সার্বিক তত্ত্বাবধান ও দলীয় প্রয়াস
এই প্রযোজনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন পথিক রানা ও মোক্তার হোসেন, যাদের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় একটি দলগত কাজ পরিণত হয়েছে একক শিল্পে। তারা কেবল ব্যবস্থাপনার কাজ করেননি, বরং শিল্পীদের সৃজনশীলতাকে সংগঠিত করে নাটকটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ নাট্যপ্রযোজনায় রূপ দিয়েছেন।
উপসংহার
“অগ্নি দর্পন” নাটকটি শুধু একটি নাটক নয়, এটি এক সামাজিক আত্মসমালোচনার আয়না, যেখানে দর্শক নিজেকে দেখতে বাধ্য হন। নাটকটি প্রমাণ করে যে ভালো নাটক কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির নয়, বরং তা সকল দর্শকের অনুভবের জায়গা হতে পারে। নাট্যরচনার গুণ, নির্দেশনার মুন্সিয়ানা, শিল্প উপস্থাপনার নান্দনিকতা ও সাংগঠনিক পরিপক্বতা—সব মিলিয়ে পূর্ব-পশ্চিম নাট্যসমনের এই প্রযোজনা সমসাময়িক বাংলা নাট্যধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এটি ভবিষ্যতে নাট্যপ্রেমী দর্শকদের জন্য শুধু একবার দেখা নয়, বারবার ফিরে আসার মতো একটি শিল্পকর্ম হয়ে থাকবে। “অগ্নি দর্পন” যেন আমাদের প্রতিদিনের জীবনের এক বার্তা—নিজেকে দেখো, সমাজকে বোঝো, আর পরিবর্তনের জন্য সাহসী হও।