
লামিয়া ইসলাম নওশীন
স্টাফ রিপোর্টার
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা নোয়াখালি সম্প্রতি এক দীর্ঘস্থায়ী তাপদাহের সম্মুখীন হয়। দিনের পর দিন অসহনীয় গরমে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। সূর্যের উত্তাপে পুড়ে যেতে থাকে মাঠ-ঘাট, ফসল ও গাছপালা। এমন পরিস্থিতিতে জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অবশেষে সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে, বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টির দেখা মিলল। গতকাল সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ শুরু হওয়া দমকা হাওয়ার মাধ্যমে আবহাওয়ার পরিবর্তনের ইঙ্গিত মেলে। রাত যত গভীর হতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে বাতাসের গতি এবং গুঞ্জন ওঠে এক সম্ভাব্য ভারি বর্ষণের।
বৃষ্টির আগমনে নোয়াখালির আকাশে জমে থাকা কালো মেঘগুলি ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলে পুরো অঞ্চল। বজ্রসহ তীব্র ঝোড়ো হাওয়ায় আশেপাশের গাছপালা দুলতে থাকে, কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেকেই তড়িঘড়ি করে নিরাপদ স্থানে চলে যায়, আবার কেউ কেউ বৃষ্টির পূর্বাভাসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে শুরু করে। এই বৃষ্টি শুধুমাত্র নোয়াখালির মানুষের তাপদাহ থেকে মুক্তির বার্তা নয়, বরং কৃষি, পরিবেশ ও সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য আশার আলো হয়ে দেখা দেয়।
তাপদাহের প্রভাব
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে নোয়াখালিসহ দেশের অনেক অঞ্চলে তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এই তাপপ্রবাহে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হয়, শ্রমজীবী মানুষদের কাজের গতি কমে যায়, কৃষিজমিতে পানির সংকট তীব্রতর হয়। এমনকি বিভিন্ন জায়গায় পানির অভাবে গবাদিপশু ও পাখিরাও কষ্ট পায়। কিছু অঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে, যা তাপদাহের ভয়াবহতা তুলে ধরে।
তাপদাহের ফলে ধানের ক্ষেতে ফাটল ধরে, অনেক সবজি শুকিয়ে যায়। সেচের উপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে, ফলে কৃষকের খরচও বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় একটানা কয়েক দিনের বৃষ্টিপাত এই সংকট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি এনে দিতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস
আবহাওয়া অধিদপ্তর ইতোমধ্যে জানিয়েছে, আগামী পাঁচ দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা এবং ঢাকা বিভাগের কিছু এলাকায় তীব্র বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে ভূমিধসের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
নোয়াখালির ক্ষেত্রে, এই বৃষ্টি কৃষির জন্য যেমন আশীর্বাদ, তেমনি শহর এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনকে আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যায়।
মানুষের প্রতিক্রিয়া ও স্বস্তি
বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়তেই নোয়াখালির মানুষ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। রাস্তাঘাটে অনেককে দেখা যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির স্পর্শ উপভোগ করতে। শিশুরা খেলায় মেতে ওঠে, গৃহিণীরা হাঁসিমুখে বারান্দা থেকে বৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করেন। দীর্ঘদিনের গরমে ক্লান্ত মানুষজনের মুখে নতুন করে হাসি ফোটে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বৃষ্টির ছবি, ভিডিও পোস্ট করে আনন্দ ভাগাভাগি করেন।
শুধু মানসিক স্বস্তিই নয়, পরিবেশের দিক থেকেও বৃষ্টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাতাসে জমে থাকা ধুলাবালি ও বিষাক্ত কণাগুলি ধুয়ে যায়, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। পুকুর, খাল-বিল আবারও পানিতে ভরে ওঠে, গাছপালা সতেজ হয়ে ওঠে।
বৃষ্টির সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি
যদিও বৃষ্টি উপকারী, তবে একটানা ভারি বৃষ্টিপাত বিভিন্ন সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে। শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা যদি দুর্বল হয়, তবে জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। নোয়াখালির কিছু এলাকায় ইতোমধ্যে নালার পানি রাস্তায় উঠতে শুরু করেছে, যা জনদুর্ভোগের কারণ হতে পারে। তাছাড়া, অতিরিক্ত বৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, নদী ও খালগুলোর পানি দ্রুত বেড়ে গেলে আশেপাশের গ্রামগুলোতে বন্যা দেখা দিতে পারে। তাই স্থানীয় প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সাধারণ জনগণকে একসাথে প্রস্তুতি নিতে হবে। দুর্যোগ পূর্বাভাসে কান রেখে, আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা, খাদ্য ও ওষুধ মজুদ করা প্রয়োজন।
পরিশেষে
বৃষ্টি শুধুমাত্র প্রকৃতির একটি উপাদান নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাপদাহের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে যেমন বৃষ্টির প্রয়োজন, তেমনি ভারসাম্য রক্ষার্থে এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকাও জরুরি। নোয়াখালির এই প্রতীক্ষিত বৃষ্টিপাত অনেক সমস্যার সমাধান এনে দিলেও, আমাদের সচেতনতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে এর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে।
আশা করা যায়, আগামী পাঁচ দিনের বৃষ্টিপাত প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এক নতুন জীবনীশক্তি সৃষ্টি করবে। কৃষক আবার চাষে মন দেবে, শিশুরা মুক্ত বাতাসে খেলবে, আর পরিবেশও কিছুটা হলেও ভারসাম্য ফিরে পাবে। প্রকৃতির এই উপহারকে আমরা যেন সম্মান করি, সঠিকভাবে ব্যবহার করি এবং ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণে সচেষ্ট হই।